আজ আমরা চট্টগ্রামের বৃহত্তম বৈশাখী মেলা জব্বারের বলীখেলায় যাই,কোন সন্দেহ নাই এটিই আমাদের দেশের সবচেয়ে বর্নিল ও ঐতিহ্যবাহী মেলা।শুনেছি ব্রিটিশ মিউজিয়ামের আর্কাইভে এর ভিডিও গ্রাফি আছে।আজ ছিল এই মেলার ২য় দিন,অতএব আমরা মেলার মুল আকর্ষন বলীখেলা মিস করলাম কেননা এটি প্রথম দিন অনুস্টিত হয়।তাই মন খারাপ।সেটি পুষিয়ে গেলো মেলার প্রানবন্ততা দেখে।মেলায় পকেটমার থেকে সাবধান করার জন্য অপরিচিত লোক থেকে পান বা অন্যান্য কিছু খেতে নিষেধ করা হচ্ছে এভাবে-মেলায় আগতরা মনে রাখবেন "পান খাবেন গুর গুরাই,টাকা যাবে শুর শুরাই"। কিংবা ইদুরের বিষ বিক্রেতা ক্যানভাসিং করছে-ইদুরের জ্বালায় ঘুমাইতে পারতেছেন না,ইদুর আপনাকে দিনে রাইতে মিস কল দেয়,আপনি মাত্র ৩ টাকায় আমার অষুধ নিয়ে ইদুরকে ডাইরেক্ট কল দিন,ইদুর লাইন ধইরা খাইবো,চিতকুর পাইরা মরবো।মেলা সম্পর্কে ইন্টারনেট ,দৈনিক কালের কন্ঠ(এরা বেশ সুন্দর তথ্য দিয়েছে)ও দৈনিক আজাদী সম্পাদিত হাজার বছরের চট্টগ্রাম থেকে তথ্য ধার করলাম।
জব্বারের বলীখেলা চট্টগ্রামের লাল দিঘী ময়দানে প্রতিবছরের ১২ই বৈশাখ তারিখে অনুষ্ঠিত কুস্তি প্রতিযোগিতা। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কুস্তি বলিখেলা নামে পরিচিত। ১৯০৯ সালে চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর এই প্রতিযোগিতার সূচনা করেন। তার মৃত্যুর পর এই প্রতিযোগিতা জব্বারের বলী খেলা নামে পরিচিতি লাভ করে। বলীখেলাকে কেন্দ্র করে লালদিঘী ময়দানের আশে পাশে প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়। এটি বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকার সবচেয়ে বৃহৎ বৈশাখী মেলা।
সাধারণ মানুষের কাছে জব্বারের বলীখেলা হিসেবে প্রসিদ্ধ এ খেলার আসল আকর্ষণ মেলা। খেলাকে কেন্দ্র করে তিন দিনের আনুষ্ঠানিক মেলা বসার কথা থাকলেও কার্যত পাঁচ-ছয় দিনের মেলা বসে লালদীঘির ময়দানের চারপাশের এলাকা ঘিরে। এই বলীখেলার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন চট্টগ্রাম নগরের বক্সিরহাট ওয়ার্ডের বদরপাতি এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী প্রয়াত আবদুল জব্বার সওদাগর। প্রবীণ ব্যক্তিদের কাছে জানা যায়, বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একই সঙ্গে বাঙালি যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে আবদুল জব্বার বলীখেলার আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদীঘির মাঠে এই বলীখেলার সূচনা করেন তিনি। ব্যতিক্রমধর্মী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামী-দামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন।
এখন পেশাদার বলির (কুস্তিগীর) অভাবে বলিখেলার তেমন আকর্ষণ না থাকলেও জব্বারের বলীখেলার মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে মেলা। তাই অনেকে বলীখেলার পরিবর্তে একে বৈশাখী মেলা হিসেবেই চিনে। জব্বার মিয়ার বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অহংকারে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়।
এছাড়া ১০০ বছর আগে বাংলা ১৩২২ সনে "প্রবাসী "পত্রিকায় মোহিনীমহন দাস বর্নিত "কেমন ছিল তখনকার জব্বারের বলীখেলা"কালের কন্ঠে প্রকাশিত হয় যা খুবই তথ্যবহুল।তার জবানীতে-যেটির বর্ণনা করিব তাহা 'আবদুল জব্বরের বলীখেলা' বলিয়া প্রসিদ্ধ। এই খেলা গত ১৩ বৈশাখ (!) সোমবার হইয়া গিয়াছে। প্রতি বৎসরই বৈশাখ মাসের এমনি তারিখে এই খেলা হইয়া থাকে। চট্টগ্রাম শহরের ঠিক বক্ষঃস্থলে পুরাতন কাছারির (বর্তমান থানা ও মাদ্রাসা স্কুলের) ইমারতের নিম্নস্থ ময়দানে এই খেলার স্থান করা হইয়া থাকে। ময়দানের মধ্যস্থলে মল্লগণের জন্য নির্দিষ্ট রঙ্গস্থল বাদ রাখিয়া চারিদিকে লোহার কাঁটা-তার দিয়া দোহারা বেড়া দেওয়া হয়। তৎপর সেই রঙ্গস্থলের ঠিক মধ্য-স্থলে একটি উচ্চ সুপারীগাছের থাম পুঁতিয়া তাহার উপরিভাগে একটি 'বায়ু-চক্র' বসাইয়া দেওয়া হয়, বায়ুপ্রবাহের তাড়নায় তাহা অবিরাম গতিতে ঘুরিতে থাকে, এবং তন্মধ্যে বসান কয়েকটি ছবির তরঙ্গায়িত গতি দেখিতে পাওয়া যায়। সুপারীগাছের থামটি রঙিন কাগজ দিয়া মুড়িয়া দেওয়া হয় এবং তাহার অগ্রভাগ হইতে কয়েকটি রশিতে ঝুলান বিচিত্রবর্ণের পতাকাশ্রেণি চারিদিকে টানিয়া বাঁধা হয়। এবং চারিদিকে বংশদণ্ডের উপর নানাবর্ণের পতাকা-সকল উড়িতে থাকে। রঙ্গস্থলের এক পাশ্র্বে কয়েকটি সামিয়ানা খাটাইয়া নিমন্ত্রিত দর্শকগণের বসিবার বন্দোবস্ত করা হয়। রবাহূত ব্যক্তিগণ চারিদিকে দাঁড়াইয়া বসিয়া গাছে ছাদে চড়িয়া এই দৃশ্য দর্শন করে। পাহাড়ের ঢালুগাত্রে লোকগুলি কেমন গ্যালারীর ন্যায় উপবেশন করিয়াছে তাহা সহজে অনুমান করা যাইবে। এই ব্যাপারে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী হইতে আরম্ভ করিয়া উকিল আমলা এবং সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ সকলেই নিমন্ত্রিত থাকেন। এই উদ্দেশ্যে অনেক অফিস আদালতের অর্ধ কাছারি হয়।
ক্রমে দিন রাত্রি প্রভাতের পূর্ব হইতে চট্টগ্রামের স্থানীয় ডোম বাদ্যকরগণের ঢোল কাড়া সানাইয়ের মিশ্রিত একঘেয়ে আওয়াজে প্রাণ ওষ্ঠাগত হইয়া উঠিতে থাকে। এবং ঘন ঘন বোমের আওয়াজ হইতে থাকে। নানা স্থান হইতে দোকানীরা আসিয়া মেলার উপযোগী দোকান সাজাইতে আরম্ভ করে। মেলায় 'নাগরদোলা' 'রাধাচক্র', এমন কি ছোটখাট ভুঁয়ে-গেঁয়ে সার্কাসের দলও আগমন করিয়া থাকে।
ক্রমে বলীগণ আসিয়া উপস্থিত হয়। এক একজন বলীর সহিত তাহার সহচর সাথী প্রায় ১০০/১৫০ লোক দলবদ্ধ হইয়া আগমন করে। রঙ্গস্থল হইতে ঢোল বাজাইতে বাজাইতে যাইয়া তাহাদিগকে 'থলার' মধ্যে আগবাড়াইয়া আনিতে হয়। একে দুয়ে, দশেবিশে, দলে দলে প্রায় ৫০০০ দর্শক ক্রীড়াস্থলে সমবেত হয়। মোটর গাড়ি, মোটর বাস, গাড়ি ঘোড়ার অবিরামগতিতে শহর তোলপাড় হইতে থাকে। উত্তেজিত জনসঙ্ঘকে পথে আসিতে আসিতে বলীখেলার কথা ভিন্ন অন্য কথা বড় একটা বলিতে শোনা যায় না। কোন্ বলী বড়, কাহার 'তাকত' বেশি, কাহার সঙ্গে কাহার কুস্তি হইবার সম্ভাবনা, কে কাহাকে হারাইবে, ইত্যাকার কোলাহলে শহর মুখরিত হইয়া উঠে। কেহ কাহাকে জিজ্ঞাসা করিতেছে 'সালামমাউ, কুঁড়ে যাওর?' অন্য-উত্তর দিতেছে 'এককানা বলীখেলা চাইতাম যাইর।' ইত্যাদি দেখিতে দেখিতে স্থানটি লোকারণ্যে পরিণত হয়। বেলা দশটার পর মল্লগণ আসরে অবতীর্ণ হইতে থাকে। তখন সজোরে ঢোলে লাঠি পড়িতে থাকে এবং আরো ঘন ঘন বোম ফুটিতে থাকে। শিক্ষিত ব্যক্তিগণের মধ্যে কেহ কেহ উপস্থিত থাকিয়া মধ্যস্থতা করিয়া থাকেন। বেলা দশটার পর হইতে জনতার ভিড় এত বাড়িতে থাকে যেন তখন রাস্তা দিয়া গাড়ি ঘোড়া চলাচলও প্রায় বন্ধ হইয়া যায়। খেলা আরম্ভ হইলে মল্লগণ রঙ্গস্থলে অবতীর্ণ হইয়া বাদ্যের তালে তালে নৃত্য করিতে থাকে এবং মালসাটে প্রতিপক্ষকে ক্রীড়ার আহ্বানসূচক সঙ্কেত করিতে থাকে। এখানকার খেলার নিয়ম এই যে ৮/১০ জোড়া বলী বা পালোয়ান একসঙ্গে কুস্তী আরম্ভ করে।
মল্লগণের মধ্যে একজন আরেকজনকে 'চিৎপট্কান' দিতে পারিলেই তাহার জিত হইল। কোন বলী কাহাকেও হারাইতে পারিলে উপস্থিত জনতার মধ্য হইতে যে গভীর আনন্দধ্বনি উত্থিত হয় তাহাতে গগন বিদীর্ণ হইবার উপক্রম হয়। যে বলী জয়লাভ করে সে খেলাদাতার নিকট হইতে যথোপযুক্তরূপে বস্ত্র ও অর্থাদি পুরস্কার লাভ করিয়া থাকে। এরূপে অনেক জোড়া বলী যার যার কেরামৎ দেখাইয়া পুরস্কার লইয়া যায়।
দুঃখের বিষয়ে ঢাকার, কলিকাতার ও পশ্চিমী পালোয়ানগণের খেলার প্রতিযোগিতায় প্রতিপক্ষগণ একে অন্যকে হারাইবার জন্য যে-সকল অপূর্ব কৌশল (প্যাঁচ) দেখাইয়া থাকে, এক এক জোড়া মল্লের খেলায় যেরূপ ২/৪ ঘণ্টা সময় অতিবাহিত হয়, এখানকার মল্লগণের খেলায় তাহার অনুরূপ বড় বেশী কিছু-দেখিতে পাওয়া যায় না_এক এক জোড়ার খেলায় ১০/১৫ মিনিটের বেশি সময় লাগে না। ইহার কারণ স্থানীয় বলীগণ অধিকাংশই 'ভুঁইফোঁড়', এখানে কুস্তী কসরত শিক্ষার তেমন কোন নির্দিষ্ট 'আখড়া' নাই। নিজে নিজে যে যত দেহের শক্তি সঞ্চয় করিতে পারে সেই তত বড় বলী বলিয়া পরিগণিত হয়। এখানে বলী খেলার যেরূপ একাগ্রতা আছে, যেরূপ উন্মাদনা আছে, তাহাতে যদি কসরৎ ও কৌশলাদি শিক্ষার তেমন কোন ব্যবস্থা থাকিত তবে সোনায় সোহাগা হইত সন্দেহ নাই। আশা করি খেলার অনুষ্ঠানকারীগণ এ বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী হইবেন। এবং সময় সময় ঢাকা প্রভৃতি স্থান হইতে নামজাদা পালোয়ানদিগকে আনাইয়া বলীখেলার প্রকরণ শিক্ষার ব্যবস্থা করিয়া ইহার উন্নতিসাধনে যত্নবান হইবেন।
সন্ধ্যার প্রাক্কালে খেলা ভাঙিয়া যায়। তখন রুদ্ধ জল স্রোত হঠাৎ মুক্ত হাওয়ার ন্যায় জনসঙ্ঘ গৃহাভিমুখে প্রস্থান করে। বহুদূর হইতে আগত বলীগণ তাহাদের পাথেয় ও খোরাকী ইত্যাদি পায়। এ উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠাতার ৪০০/৫০০ টাকা ব্যয় হইয়া থাকে। চট্টগ্রাম মুসলমান প্রধান স্থান বলিয়া দর্শকগণের প্রায় পনর আনাই মুসলমান।
চট্টগ্রামের বলীখেলার ভিতর যে চেতনাটুকু এখনও ক্ষীণ দীপালোকের মত জ্বলিতেছে তাহাতে কিঞ্চিৎ উৎসাহের তৈলসেক করিয়া যদি ইহাকে সর্বত্র এইরূপ সচেতন করা যায় এবং পূর্বকালের ব্যায়াম কৌশলপূর্ণ ক্রীড়াদি পুনরায় নিঃসঙ্কোচ গ্রহণ করিয়া আমাদের ভাবী বংশধরগণের ব্যায়ামের ব্যবস্থা করা যায়, তবে এই পোড়া বাংলায় আবার স্বাস্থ্যের উজ্জ্বলতেজ প্রদীপ্ত হইয়া উঠিতে পারে।
এবার প্রতিযোগী বলী ও মল্ল সম্পর্কে কিছু তথ্য(সুত্র-কালের কন্ঠ)।
মল্ল পরিবার ও আনিক্যা বলি সম্প্রদায়ঃ
কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী স্থানের উনিশটি গ্রামে মল্ল উপাধিধারী মানুষের বসবাসের কথা রয়েছে পূর্ণচন্দ্র চৌধুরীর চট্টগ্রামের ইতিহাস বইয়ে। মল্লরা ছিলেন শক্তিশালী ও সুঠামদেহী। শারীরিক কসরৎ প্রদর্শনই ছিল তাদের পেশা। এই মল্লবীরেরাই ছিলেন বলীখেলার প্রধান আকর্ষণ ও বলীখেলা আয়োজনের মূল প্রেরণা।
চট্টগ্রামের ইতিহাসপ্রসিদ্ধ ২২টি মল্ল পরিবারের কথা পাওয়া যায় ইতিহাসবিদ আবদুল হক চৌধুরীর 'বন্দর শহর চট্টগ্রাম' (পৃ. ২৪৪) বইয়ে। যেমন_আশিয়া গ্রামের আমান শাহ মল্ল, চাতরির চিকন মল্ল, কাতারিয়ার চান্দ মল্ল, জিরির ঈদ মল্ল ও নওয়াব মল্ল, পারির হরি মল্ল, পেরলার নানু মল্ল, পটিয়ার হিলাল মল্ল ও গোরাহিত মল্ল, হাইদগাঁওয়ের অলি মল্ল ও মোজাহিদ মল্ল, শোভনদণ্ডীর তোরপাচ মল্ল, কাঞ্চননগরের আদম মল্ল, ঈশ্বরখাইনের গনি মল্ল, সৈয়দপুরের কাসিম মল্ল, পোপাদিয়ার যুগী মল্ল, খিতাপচরের খিতাপ মল্ল, ইমামচরের ইমাম মল্ল, নাইখাইনের বোতাত মল্ল, মাহাতার এয়াছিন মল্ল, হুলাইনের হিম মল্ল, গৈরলার চুয়ান মল্ল। তবে পূর্বপুরুষের পেশা থেকে সরে গেছেন অনেক মল্ল।
আনিক্যা বলী নামে একটি সম্প্রদায় আছে চট্টগ্রামে। একসময় বলী হিসেবে তাদের খুব নাম-ডাক ছিল। কুস্তির প্যাঁচে আনিক্যারা ছিল ওস্তাদ। এ সম্প্রদায়ের দু-একজনকে এখনও লালদীঘির বলী খেলায় দেখা যায়। আনিক্যা বলীরা সাধারণত আসেন চকরিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, উখিয়া, রামু, টেকনাফ থেকে।
সুত্রঃ-ইন্টারনেট,দৈনিক কালের কন্ঠ,দৈনিক আজাদী।
জব্বারের বলীখেলা চট্টগ্রামের লাল দিঘী ময়দানে প্রতিবছরের ১২ই বৈশাখ তারিখে অনুষ্ঠিত কুস্তি প্রতিযোগিতা। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কুস্তি বলিখেলা নামে পরিচিত। ১৯০৯ সালে চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর এই প্রতিযোগিতার সূচনা করেন। তার মৃত্যুর পর এই প্রতিযোগিতা জব্বারের বলী খেলা নামে পরিচিতি লাভ করে। বলীখেলাকে কেন্দ্র করে লালদিঘী ময়দানের আশে পাশে প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়। এটি বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকার সবচেয়ে বৃহৎ বৈশাখী মেলা।
সাধারণ মানুষের কাছে জব্বারের বলীখেলা হিসেবে প্রসিদ্ধ এ খেলার আসল আকর্ষণ মেলা। খেলাকে কেন্দ্র করে তিন দিনের আনুষ্ঠানিক মেলা বসার কথা থাকলেও কার্যত পাঁচ-ছয় দিনের মেলা বসে লালদীঘির ময়দানের চারপাশের এলাকা ঘিরে। এই বলীখেলার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন চট্টগ্রাম নগরের বক্সিরহাট ওয়ার্ডের বদরপাতি এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী প্রয়াত আবদুল জব্বার সওদাগর। প্রবীণ ব্যক্তিদের কাছে জানা যায়, বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একই সঙ্গে বাঙালি যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে আবদুল জব্বার বলীখেলার আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদীঘির মাঠে এই বলীখেলার সূচনা করেন তিনি। ব্যতিক্রমধর্মী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামী-দামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন।
এখন পেশাদার বলির (কুস্তিগীর) অভাবে বলিখেলার তেমন আকর্ষণ না থাকলেও জব্বারের বলীখেলার মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে মেলা। তাই অনেকে বলীখেলার পরিবর্তে একে বৈশাখী মেলা হিসেবেই চিনে। জব্বার মিয়ার বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অহংকারে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়।
এছাড়া ১০০ বছর আগে বাংলা ১৩২২ সনে "প্রবাসী "পত্রিকায় মোহিনীমহন দাস বর্নিত "কেমন ছিল তখনকার জব্বারের বলীখেলা"কালের কন্ঠে প্রকাশিত হয় যা খুবই তথ্যবহুল।তার জবানীতে-যেটির বর্ণনা করিব তাহা 'আবদুল জব্বরের বলীখেলা' বলিয়া প্রসিদ্ধ। এই খেলা গত ১৩ বৈশাখ (!) সোমবার হইয়া গিয়াছে। প্রতি বৎসরই বৈশাখ মাসের এমনি তারিখে এই খেলা হইয়া থাকে। চট্টগ্রাম শহরের ঠিক বক্ষঃস্থলে পুরাতন কাছারির (বর্তমান থানা ও মাদ্রাসা স্কুলের) ইমারতের নিম্নস্থ ময়দানে এই খেলার স্থান করা হইয়া থাকে। ময়দানের মধ্যস্থলে মল্লগণের জন্য নির্দিষ্ট রঙ্গস্থল বাদ রাখিয়া চারিদিকে লোহার কাঁটা-তার দিয়া দোহারা বেড়া দেওয়া হয়। তৎপর সেই রঙ্গস্থলের ঠিক মধ্য-স্থলে একটি উচ্চ সুপারীগাছের থাম পুঁতিয়া তাহার উপরিভাগে একটি 'বায়ু-চক্র' বসাইয়া দেওয়া হয়, বায়ুপ্রবাহের তাড়নায় তাহা অবিরাম গতিতে ঘুরিতে থাকে, এবং তন্মধ্যে বসান কয়েকটি ছবির তরঙ্গায়িত গতি দেখিতে পাওয়া যায়। সুপারীগাছের থামটি রঙিন কাগজ দিয়া মুড়িয়া দেওয়া হয় এবং তাহার অগ্রভাগ হইতে কয়েকটি রশিতে ঝুলান বিচিত্রবর্ণের পতাকাশ্রেণি চারিদিকে টানিয়া বাঁধা হয়। এবং চারিদিকে বংশদণ্ডের উপর নানাবর্ণের পতাকা-সকল উড়িতে থাকে। রঙ্গস্থলের এক পাশ্র্বে কয়েকটি সামিয়ানা খাটাইয়া নিমন্ত্রিত দর্শকগণের বসিবার বন্দোবস্ত করা হয়। রবাহূত ব্যক্তিগণ চারিদিকে দাঁড়াইয়া বসিয়া গাছে ছাদে চড়িয়া এই দৃশ্য দর্শন করে। পাহাড়ের ঢালুগাত্রে লোকগুলি কেমন গ্যালারীর ন্যায় উপবেশন করিয়াছে তাহা সহজে অনুমান করা যাইবে। এই ব্যাপারে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী হইতে আরম্ভ করিয়া উকিল আমলা এবং সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ সকলেই নিমন্ত্রিত থাকেন। এই উদ্দেশ্যে অনেক অফিস আদালতের অর্ধ কাছারি হয়।
ক্রমে দিন রাত্রি প্রভাতের পূর্ব হইতে চট্টগ্রামের স্থানীয় ডোম বাদ্যকরগণের ঢোল কাড়া সানাইয়ের মিশ্রিত একঘেয়ে আওয়াজে প্রাণ ওষ্ঠাগত হইয়া উঠিতে থাকে। এবং ঘন ঘন বোমের আওয়াজ হইতে থাকে। নানা স্থান হইতে দোকানীরা আসিয়া মেলার উপযোগী দোকান সাজাইতে আরম্ভ করে। মেলায় 'নাগরদোলা' 'রাধাচক্র', এমন কি ছোটখাট ভুঁয়ে-গেঁয়ে সার্কাসের দলও আগমন করিয়া থাকে।
ক্রমে বলীগণ আসিয়া উপস্থিত হয়। এক একজন বলীর সহিত তাহার সহচর সাথী প্রায় ১০০/১৫০ লোক দলবদ্ধ হইয়া আগমন করে। রঙ্গস্থল হইতে ঢোল বাজাইতে বাজাইতে যাইয়া তাহাদিগকে 'থলার' মধ্যে আগবাড়াইয়া আনিতে হয়। একে দুয়ে, দশেবিশে, দলে দলে প্রায় ৫০০০ দর্শক ক্রীড়াস্থলে সমবেত হয়। মোটর গাড়ি, মোটর বাস, গাড়ি ঘোড়ার অবিরামগতিতে শহর তোলপাড় হইতে থাকে। উত্তেজিত জনসঙ্ঘকে পথে আসিতে আসিতে বলীখেলার কথা ভিন্ন অন্য কথা বড় একটা বলিতে শোনা যায় না। কোন্ বলী বড়, কাহার 'তাকত' বেশি, কাহার সঙ্গে কাহার কুস্তি হইবার সম্ভাবনা, কে কাহাকে হারাইবে, ইত্যাকার কোলাহলে শহর মুখরিত হইয়া উঠে। কেহ কাহাকে জিজ্ঞাসা করিতেছে 'সালামমাউ, কুঁড়ে যাওর?' অন্য-উত্তর দিতেছে 'এককানা বলীখেলা চাইতাম যাইর।' ইত্যাদি দেখিতে দেখিতে স্থানটি লোকারণ্যে পরিণত হয়। বেলা দশটার পর মল্লগণ আসরে অবতীর্ণ হইতে থাকে। তখন সজোরে ঢোলে লাঠি পড়িতে থাকে এবং আরো ঘন ঘন বোম ফুটিতে থাকে। শিক্ষিত ব্যক্তিগণের মধ্যে কেহ কেহ উপস্থিত থাকিয়া মধ্যস্থতা করিয়া থাকেন। বেলা দশটার পর হইতে জনতার ভিড় এত বাড়িতে থাকে যেন তখন রাস্তা দিয়া গাড়ি ঘোড়া চলাচলও প্রায় বন্ধ হইয়া যায়। খেলা আরম্ভ হইলে মল্লগণ রঙ্গস্থলে অবতীর্ণ হইয়া বাদ্যের তালে তালে নৃত্য করিতে থাকে এবং মালসাটে প্রতিপক্ষকে ক্রীড়ার আহ্বানসূচক সঙ্কেত করিতে থাকে। এখানকার খেলার নিয়ম এই যে ৮/১০ জোড়া বলী বা পালোয়ান একসঙ্গে কুস্তী আরম্ভ করে।
মল্লগণের মধ্যে একজন আরেকজনকে 'চিৎপট্কান' দিতে পারিলেই তাহার জিত হইল। কোন বলী কাহাকেও হারাইতে পারিলে উপস্থিত জনতার মধ্য হইতে যে গভীর আনন্দধ্বনি উত্থিত হয় তাহাতে গগন বিদীর্ণ হইবার উপক্রম হয়। যে বলী জয়লাভ করে সে খেলাদাতার নিকট হইতে যথোপযুক্তরূপে বস্ত্র ও অর্থাদি পুরস্কার লাভ করিয়া থাকে। এরূপে অনেক জোড়া বলী যার যার কেরামৎ দেখাইয়া পুরস্কার লইয়া যায়।
দুঃখের বিষয়ে ঢাকার, কলিকাতার ও পশ্চিমী পালোয়ানগণের খেলার প্রতিযোগিতায় প্রতিপক্ষগণ একে অন্যকে হারাইবার জন্য যে-সকল অপূর্ব কৌশল (প্যাঁচ) দেখাইয়া থাকে, এক এক জোড়া মল্লের খেলায় যেরূপ ২/৪ ঘণ্টা সময় অতিবাহিত হয়, এখানকার মল্লগণের খেলায় তাহার অনুরূপ বড় বেশী কিছু-দেখিতে পাওয়া যায় না_এক এক জোড়ার খেলায় ১০/১৫ মিনিটের বেশি সময় লাগে না। ইহার কারণ স্থানীয় বলীগণ অধিকাংশই 'ভুঁইফোঁড়', এখানে কুস্তী কসরত শিক্ষার তেমন কোন নির্দিষ্ট 'আখড়া' নাই। নিজে নিজে যে যত দেহের শক্তি সঞ্চয় করিতে পারে সেই তত বড় বলী বলিয়া পরিগণিত হয়। এখানে বলী খেলার যেরূপ একাগ্রতা আছে, যেরূপ উন্মাদনা আছে, তাহাতে যদি কসরৎ ও কৌশলাদি শিক্ষার তেমন কোন ব্যবস্থা থাকিত তবে সোনায় সোহাগা হইত সন্দেহ নাই। আশা করি খেলার অনুষ্ঠানকারীগণ এ বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী হইবেন। এবং সময় সময় ঢাকা প্রভৃতি স্থান হইতে নামজাদা পালোয়ানদিগকে আনাইয়া বলীখেলার প্রকরণ শিক্ষার ব্যবস্থা করিয়া ইহার উন্নতিসাধনে যত্নবান হইবেন।
সন্ধ্যার প্রাক্কালে খেলা ভাঙিয়া যায়। তখন রুদ্ধ জল স্রোত হঠাৎ মুক্ত হাওয়ার ন্যায় জনসঙ্ঘ গৃহাভিমুখে প্রস্থান করে। বহুদূর হইতে আগত বলীগণ তাহাদের পাথেয় ও খোরাকী ইত্যাদি পায়। এ উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠাতার ৪০০/৫০০ টাকা ব্যয় হইয়া থাকে। চট্টগ্রাম মুসলমান প্রধান স্থান বলিয়া দর্শকগণের প্রায় পনর আনাই মুসলমান।
চট্টগ্রামের বলীখেলার ভিতর যে চেতনাটুকু এখনও ক্ষীণ দীপালোকের মত জ্বলিতেছে তাহাতে কিঞ্চিৎ উৎসাহের তৈলসেক করিয়া যদি ইহাকে সর্বত্র এইরূপ সচেতন করা যায় এবং পূর্বকালের ব্যায়াম কৌশলপূর্ণ ক্রীড়াদি পুনরায় নিঃসঙ্কোচ গ্রহণ করিয়া আমাদের ভাবী বংশধরগণের ব্যায়ামের ব্যবস্থা করা যায়, তবে এই পোড়া বাংলায় আবার স্বাস্থ্যের উজ্জ্বলতেজ প্রদীপ্ত হইয়া উঠিতে পারে।
এবার প্রতিযোগী বলী ও মল্ল সম্পর্কে কিছু তথ্য(সুত্র-কালের কন্ঠ)।
মল্ল পরিবার ও আনিক্যা বলি সম্প্রদায়ঃ
কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী স্থানের উনিশটি গ্রামে মল্ল উপাধিধারী মানুষের বসবাসের কথা রয়েছে পূর্ণচন্দ্র চৌধুরীর চট্টগ্রামের ইতিহাস বইয়ে। মল্লরা ছিলেন শক্তিশালী ও সুঠামদেহী। শারীরিক কসরৎ প্রদর্শনই ছিল তাদের পেশা। এই মল্লবীরেরাই ছিলেন বলীখেলার প্রধান আকর্ষণ ও বলীখেলা আয়োজনের মূল প্রেরণা।
চট্টগ্রামের ইতিহাসপ্রসিদ্ধ ২২টি মল্ল পরিবারের কথা পাওয়া যায় ইতিহাসবিদ আবদুল হক চৌধুরীর 'বন্দর শহর চট্টগ্রাম' (পৃ. ২৪৪) বইয়ে। যেমন_আশিয়া গ্রামের আমান শাহ মল্ল, চাতরির চিকন মল্ল, কাতারিয়ার চান্দ মল্ল, জিরির ঈদ মল্ল ও নওয়াব মল্ল, পারির হরি মল্ল, পেরলার নানু মল্ল, পটিয়ার হিলাল মল্ল ও গোরাহিত মল্ল, হাইদগাঁওয়ের অলি মল্ল ও মোজাহিদ মল্ল, শোভনদণ্ডীর তোরপাচ মল্ল, কাঞ্চননগরের আদম মল্ল, ঈশ্বরখাইনের গনি মল্ল, সৈয়দপুরের কাসিম মল্ল, পোপাদিয়ার যুগী মল্ল, খিতাপচরের খিতাপ মল্ল, ইমামচরের ইমাম মল্ল, নাইখাইনের বোতাত মল্ল, মাহাতার এয়াছিন মল্ল, হুলাইনের হিম মল্ল, গৈরলার চুয়ান মল্ল। তবে পূর্বপুরুষের পেশা থেকে সরে গেছেন অনেক মল্ল।
আনিক্যা বলী নামে একটি সম্প্রদায় আছে চট্টগ্রামে। একসময় বলী হিসেবে তাদের খুব নাম-ডাক ছিল। কুস্তির প্যাঁচে আনিক্যারা ছিল ওস্তাদ। এ সম্প্রদায়ের দু-একজনকে এখনও লালদীঘির বলী খেলায় দেখা যায়। আনিক্যা বলীরা সাধারণত আসেন চকরিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, উখিয়া, রামু, টেকনাফ থেকে।
সুত্রঃ-ইন্টারনেট,দৈনিক কালের কন্ঠ,দৈনিক আজাদী।