লেনিনের মৃত্যুর অব্যাবহতি পরই স্টালিন ১৯২৪ সালে সোভিয়েত কমিউনিস্ট
পার্টির দায়িত্ব নেয়।এর পর সে ১ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ,২য় পঞ্চবার্ষিকী
পরিকল্পনা পর্যন্ত তার প্রতিপক্ষদের প্রতি কিছুটা রক্ষনশীল ভুমিকায় অবতীর্ন
হন।কেননা,তার তখন ব্যস্ত থাকতে হয় বিভিন্ন প্রতিবিপ্লবী,কমিউনিস্ট বিরোধী
সংগঠন গুলোর বিরুদ্ধে,গৃহযুদ্ধের বিরুদ্ধে।এর পাশাপাশি চলছিলো বিভিন্ন
স্বায়ত্বশাসিত দেশগুলোর সোভিয়েতি করন।১৯২৪ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে
স্বায়ত্বশাসিত মধ্য এশিয়ার
উজবেকিস্তান,কাজাখস্তান,কিরগেজিস্তান,তাজিকিস্তান,তুর্কমেনিস্তান,আজারবাইজান,আরমেনিয়া,জর্জিয়া,ইউক্রেন,মোলদাভিয়া,বেলোরুশিয়া,এস্তোনিয়া
সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক দেশে রুপান্তরিত হয়।
স্টালিনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি নিধন অভিযানের
সর্বপ্রথম ধারনা পান ট্রটস্কি।তিনি সোভিয়েত দেশ থেকে পালিয়ে মেক্সিকো চলে
যান।কিন্তু লাভ হলো না,১৯৪০ সালে শুদ্ধি অভিযানের সমাপ্তি পর্বে তিনি
মেক্সিকোতেই লাইব্রেরীতে আততায়ীর হাতে প্রান হারান।তার মাথায় হাতুড়ি দিয়ে
আঘাত হানা হয়।প্রাক শুদ্ধি অভিযান প্রকৃতপক্ষে ১৯৩২ সালের পরই শুরু হয়।এবং
তা চালানো হয় কমিউনিস্ট পার্টি,লাল ফৌজ ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর
অভ্যন্তরে।আক্রান্তদের অভিযুক্ত করা হতো প্রতি বিপ্লবী ও জনশত্রু
হিসেবে।প্রবর্তন করা হয় আর্টিকেল ৫৮ ধারা,এই কালাকানুনই স্টালিন মারা
যাওয়ার আগ পর্যন্ত বিপুল লোকের প্রানহানী ঘটায়।অদ্ভুত হলেও সত্য,ম্যাক্সিম
গোর্কি ও লেনিন স্ত্রী নাদেজদা স্ক্রপস্কায়া পর্যন্ত আমৃত্যু গৃহবন্দী
ছিলেন।ট্রটস্কি পালিয়ে যাবার পর লেনিন গ্রাদের জনপ্রিয় কমিউনিস্ট নেতা
সার্গেই কিরভ অত্যান্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠে।কিন্তু ১৯৩৪ সালে তাকে
লেনিন-গ্রাদের স্মোলনি ইন্সটিটিউটে আততায়ী গুলি করে হত্যা করে।এটা পরিস্কার
ছিলো কাজটা স্টালিনের।কিন্তু স্টালিন এর দায় দেয় তার রাজনৈতিক
প্রতিপক্ষদের।স্টালিন নিজে কিরভের কফিন বহন করে সবাইকে বুঝায় যে,তিনি কি
মর্মাহত!
বলা যায়,কিরভ হত্যার পরই স্টালিনের গ্রেট পার্জ বা শুদ্ধি অভিযানের ডেব্যু
হয়।এর পর ১৯৩৫ সালে লাল ফৌজে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়।সে সময় সোভিয়েত ফৌজে ৫
জন মার্শাল ছিলেন।এরা হলেন মিখাইল তুখাচেভস্কি,আলেকজান্দার ইলিচ
ইয়েগরভ,ভাসিলি কন্সটানটিনোভিচ ব্লিউখের,সেমিওন বুদিউন্নী ও ক্লাইমেন্ট
ভরোশিলভ।এদের মধ্যে মিখাইল তুখাচেভস্কি ছিলো সে সময়ের সবচেয়ে মেধাবি
মার্শাল।তার সেনাবাহিনীকে মেকানাইজড করার সুত্র স্বয়ং জার্মান সেনাবাহিনী
অনুসরন করতো।তিনি ত্রিশের দশকেই স্টালিনকে সেনাবাহিনীকে দ্রুত মেকানাইজড ও
ভারী আর্টিলারীতে সজ্জিত এবং ট্যাংক বাহিনী সজ্জিত করার উপ জোর দেন।কিন্তু
স্টালিন তার অনুগত সেমিওন বুদিওন্নী ও ক্লাইমেন্ট ভরোশিলভের কথাই বেশী
শুনতেন।বুদিওন্নী আগের কনভেনশনাল অশ্বারোহী কোরের প্রতি দূর্বল ছিলেন।তিনি
আমাদের মীর শওকত আলীর মতো বড় গোঁফের অধিকারী ছিলেন,আর বেশীর ভাগ সময় সামরিক
কুচকাওয়াজের জন্য সুর রচনা করতেন।আবার ঘোড়ার উন্নত প্রজাতির সংকর প্রজননেও
ব্যস্ত থাকতেন।রাশিয়ায় বুদিওন্নী হর্স নামে এক প্রজাতির ঘোড়া তারই
সৃস্ট।ভরোশিলভ ও স্টালিনের প্রিয়-পাত্র ছিলেন।আমার একটি ব্যক্তিগত
ধারনা,লম্বা মোঁচওলা আর্মি অফিসার কোন কাজের না,এরা মোঁচের যত্নেই ব্যস্ত
থাকে।উদাহরন আজকের যুগেও খাটে।
স্টালিন মার্শাল তুখাচেভস্কির সেনাবাহিনীর যান্ত্রিকিকরনকে অবজ্ঞা করলেও
নাৎসি জেনারেল হাইন্স গুডেরিয়ান আর মান্সটাইনরা তা লুফে নেয়।তুখাচেভস্কি
ত্রিশের দশকেই বলে দেয়,ভবিষ্যতের স্থলযুদ্ধ হবে দ্রুত গতির।বিভিন্ন
মেকানাইজড কোর,ট্যাংক বাহিনী ও ভারী আর্টিলারীর দ্রুত প্রয়োগই যুদ্ধের মোড়
ঘুরাবে।যেটা জার্মান বাহিনী তাদের পানজার বাহিনী গঠন করে দেখিয়ে দেয়।১ম
বিশ্বযুদ্ধের পরিখা যুদ্ধের অবসান ঘটাবে এই ব্লিতসক্রিগ বা বিদ্যুৎ গতির
যুদ্ধ।স্তালিন শুধু তুখাচেভস্কিকে তার মতবাদের জন্য শাস্তিই দেননি,বরং যারা
এ মতবাদের পক্ষে ছিলো তাদেরও গোয়েন্দা পর্যবেক্ষনে রাখেন।পরবর্তীতে
মার্শাল রকসসভস্কি পর্যন্ত এ সন্দেহের মধ্যে ছিলেন।তিনি ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু
হলে এ থেকে অব্যাহতি পান।স্টালিন ১৯৩৫-৩৯ এর মধ্যে মিখাইল
তুখাচেভস্কি,আলেকজান্দার ইলিচ ইয়েগরভ,ভাসিলি কন্সটানটিনোভিচ ব্লিউখের এদের
হত্যা করে।এদের জায়গায় নতুন ৩জন মার্শাল নিয়োগ পায়,এরা হলেন মার্শাল সেমিওন
তিমোশেঙ্কো,বরিশ সাপোস্নিকভ ও গ্রিগরী কুলিক।সাপোস্নিকভ ও কুলিককে
পরবর্তীতে হত্যা করা হয়।
সেমিওন তিমোশেঙ্কো আর মার্শাল বুদিওন্নী ১৯৪১ সালে জার্মান নাজি বাহিনী দন
আর নিপার এর পশ্চিম পাশ ও দক্ষিন পাশ দখল করে নিলে স্তালিন কতৃক ডিসমিস
হন।নতুন মার্শাল হন গেওর্গি জুকোভ,ইভান কনেভ ও কন্সতানভিচ রকসসভস্কি।এ
তিনজন স্বাভাবিক ভাবেই ভাগ্যক্রমে মরতে পেরেছিলো।
এবার আবার শুদ্ধি অভিযানে ফিরে আসি।১৯৩৭ সালে স্তালিন তার প্রতিপক্ষদের ১ম
পর্যায়ে ১৬ জনকে হত্যা করে।এদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো,গ্রিগরি জিনোভিয়েভ
ও লেভ কামানেভ।এদের ট্রটস্কির সাথে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মারা হয়।২য় পর্যায়ে
১৭ জনকে মারা হয়।এদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো,কার্ল রাদেক,ইউরি পিয়তাকভ ও
গ্রিগরি সকলনিকভ।এভাবে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত প্রচুর প্রতিভাবান
বিজ্ঞানী,উদ্যানবিদ,কবি,সুরকারদের শুদ্ধি অভিযানের শিকার হতে হয়।
শুদ্ধি অভিযান চালাতো সোভিয়েত এনকেভিডি(কেজিবির আগের প্রতিস্টান)।অদ্ভুত
যে,এনকেভিডি প্রধান নিকোলাই ইয়েজব প্রচুর নিরীহ লোককে হত্যা করার পর ১৯৩৯
সালে স্টালিনের নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়।এর পর এর দায়িত্বে আসে,কুখ্যাত
লাভরেন্তি বেরিয়া।যিনি তার পদে বহাল ছিলেন স্তালিন মরার আগ মুহুর্ত
পর্যন্ত।এর পরেই অবিলম্বে তাকে হত্যা করা হয়।
শুধুমাত্র ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলেই এ শুদ্ধি অভিযান বন্ধ হয়।যুদ্ধ শেষ হলেই
আবার শুরু হয়,যা ১৯৫০ সাল পর্যন্ত চলে।এসময় বিপুল লোক ও সৈন্য যারা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছে,তাদের ও বিভিন্ন সন্দেহমুলক
কার্যক্রমে বিভিন্ন শ্রমশিবির ও গুলাগে প্রেরন করা হয়।এসময় বিভিন্ন
জাতিগোষ্ঠীর লোকদের এন্টি কমিউনিজম আখ্যা দিয়ে সাইবেরিয়ায় নির্বাসন দেয়া
হয়।ধারনা করা হয়,প্রায় কোটির কাছাকাছি মানুষ গ্রেট পার্জ বা শুদ্ধি অভিযানে
নিহত হয়।স্তালিন ২৯ বছর প্রবল প্রতাপে সোভিয়েত দেশ চালান।একমাত্র
মৃত্যুতেই তিনি ক্ষমতা হারান।শুরু হয় ডি-স্তালিনাইজেশেন,স্তালিনের পক্ষের
লোকদের বন্দী ও হত্যাকরন।এটি চলে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত।তথাপি স্টালিন ছিলেন
বিংশ শতাব্দির সফল সমরনায়ক।তার ঠান্ডা মাথার নেতৃত্বতেই জার্মান
ফ্যাসিবাদের কবর রচনা হয়।