কোন কোন মুহুর্তে সঠিকভাবে স্ট্রাটেজিক পশ্চাদপশরন শুধু জীবন বাচায় তাইই নয় বরং পরবর্তিকালে তা বিজয়ের নিয়ামক বা অনুঘটক হয়ে কাজ করে।
ক্রিস্টোফার নোলান মুভি পরিচালক হিসেবে আমার কাছে একটা আলাদা জায়গা পান।কোয়েন ব্রাদাসরা, মাইকেল মান এরা অন্যরকম স্বাদের মুভি নির্মাতা।নোলানও তাই।সে এখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে ডানকার্কে আটকে পড়া ব্রিটিস অভিযাত্রী বাহিনীর সেই অবিস্মরনীয় উদ্বাসন বা ইভাকুয়েশন নিয়ে মুভি বানাচ্ছে। নাম "ডানকার্ক"। আর ডানকার্কের কথা শুনেই আমার ৬ষ্ট ভাইকাউন্ট জেনারেল লর্ড প্রেনডারগেষ্ট ভেরেকার গর্ট এর কথা মনে পড়লো।কারো কারো জীবনের একটি কর্মই তার বাকি জীবন মুল্যায়ন করার জন্য যথেষ্ট। লর্ড গর্ট (কি অদ্ভুত নাম ,নয় কি?
মুভি নয়, ইতিহাসটা নিয়ে বলি।১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে জার্মানীর পোলান্ড দখলের পর যুদ্ধ মোটামুটি ১১ মাসের জন্য অবকাশে চলে যায়।ইংগ-ফরাসী নেতৃবৃন্দ হতবাক হয়ে পড়ে ।ফরাসীরা তাদের দূর্ভেদ্য ম্যাজিনো লাইনে অবস্থান নেয়,যা ফরাসী জার্মান সীমান্তও বটে।জার্মানরা এটাকে জিগফ্রীড লাইন বলে।এই ১১ মাসে দুই পক্ষ পরস্পরকে কেবল কুটনীতিক হুমকি ধামকি দিয়ে যাচ্ছিলো।আর দরাদরি করে কালক্ষেপন করে নিজেদের সুরক্ষা করা ব্রিটিসদের পুরান অভ্যাস।১১ মাসের নীরবতা বা ফোনি ওয়ার ভাংলো হিটলারের ব্লিতসস্ক্রিগ আক্র্মনে।এতো শক্তিশালী ফরাসী বাহিনী শুধু টিপিক্যাল জেনারেলদের হাতে থাকায় মুহুর্তেই গুড়িয়ে গেলো।ফরাসী সেনাপতি গ্যামেলিন তার হেড কোয়ার্টার ভাঁসেন থেকে কমই বের হতেন।তিনি আর জেনারেল জর্জ ভেবেছিলেন, আরে ভাবাভাবির কি আছে ,ফরাসী আর্মি প্রস্তুত ।আক্রমন ম্যাজিনো লাইন আর ১ম বিশ্বযুদ্ধের মতো আবারো বেলজিয়ামের ভেতর দিয়ে আসবে।সেই রিভলভিং ডোর শ্লাইফেন পরিকল্পনা।প্রথাগত জেনারেল শ্লাইফেনের সেই উনবিংশ শতকের পরিকল্পনা।যেটা ফ্রান্সকে বোঝাবে যে ম্যাজিনো লাইন ভেঙ্গেই আসবো,যতো কিছুই করো।কিন্তু পুবের ম্যাজিনো লাইনে পুরো ফরাসী বাহিনীকে টেনশনে বসিয়ে রেখে পশ্চিমে বেলজিয়ামের ভেতর দিয়ে একটা ঘড়ির কা্টার বিপরীত দিকে ঘোরা বক্সিং এর আদর্শ ভলি।পুরো জার্মান বাহিনী পশ্চিম থেকে ঘুরে একদল যাবে আইফেল টাওয়ারের দিকে আর আরেকটা ঝঞ্জাবাহিনী ম্যাজিনো লাইনের পিছনে বসা ফরাসীদের ধরবে।
এর বিপরীতে গ্যামেলিন বেলজিয়াম সীমান্তে ডাইল নদীতে নাৎসিদের পাওয়ার জন্য গ্যামেলিন ডাইল প্ল্যান বানান।ফরাসীদের দূর্ভাগ্য,তাদের জাতির ইতিহাসের সন্ধিক্ষনে গ্যামেলিন ,জর্জ,মার্শাল ওয়েগাদের মতো ঘাটের মড়া বুড়োগুলোকে পাওয়া।২য় বিশ্বযুদ্ধ যে ১ম বিশ্বযুদ্ধের মতো পরিখাযুদ্ধ নয়, আর ভর্দাবিজয়ী মার্শাল পেতা(পেতা ফ্রান্সে ভিসি সরকার গঠন করে ফরাসী রাজাকারের নাম কামায়) ও লড়াকু মার্শাল ফশ ও আর তখন নেই যে জাতিকে উদ্দীপিত করবে।চারদিক থেকে আক্রান্ত হয়ে ফশ তার সৈন্যদের বলেন, দেখো,আমার ডান বাম আক্রান্ত ,চারদিক অবরুদ্ধ, কিন্তু ভেতরটা গর্জাচ্ছে।আমরা আক্রমনে যাচ্ছি।
১৯৪০ এর বসন্তে ১১ মাসের নীরবতা ভেঙ্গে নাৎসিরা আক্রমন করলো।ম্যাজিনো লাইন দিয়েও নয় ,বেলজিয়েমের ভেতর দিয়েও নয়।এই দুইয়ের মধ্যবর্তী আর্দেনের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে।শেষ ২০০০ বছরের ইতিহাসে রোমান শাসক বা গথ দস্যু কেউ এই কাজটা করে নাই।এতো দূর্গম বন ভেদ করে কোন বাহিনী আসবে এটা গ্যামেলিন বা জর্জ কারো মাথায় খেলে নাই। কিন্তু নাতসি জেনারেল মানস্টাইন আর পানজার জিনিয়াস গুডেরিয়ান এই চিন্তাটা করছিলো।এই ১১ মাস চুড়ান্ত কেমোফ্লাজের সাহাজ্য নিয়ে কেবল রাতে শ্বাপদের মতো তারা এগিয়েছিলো।মুড়ির মতো গুপ্তচর ছড়িয়ে দিয়েছিলো আর্দেনের আশেপাশে।আর ফরাসিদের নিশ্চিন্তে ঘুমানোর জন্য এই জায়গায় ছিলো ফরাসী ৯ম আর্মি।আর তার অধিনায়ক জেনারেল কোরা। পুরো পানজার বাহিনী এই হতভাগ্য কোরার বাহিনীর গায়ে ঝাপিয়ে পড়ে।কোরা ১ম দিনই বীরের মতো তার সৈন্যদের নিয়ে নিহত হন।আর্মি হেড কোয়ার্টারকে শুধু জানাতে পেরেছিলেন যে তারা লড়ছেন।নিজেদের সাহায্য বিন্দুমাত্র চাননি, নাৎসিরা মেউজ নদী পেরিয়ে প্যারিস আসবে।প্যারিস বাচুক।
ফরাসী বাহিনী বিনা প্রতিরোধে গুড়িয়ে যাওয়ায় চার্চিল হতবাক ও বিহবল হয়ে জানতে চান প্রধানমন্ত্রী রেনো আর প্রতিরক্ষামন্ত্রী দালাদিয়ের কাছে,এমনকি নিয়ম ভেঙ্গে গ্যামেলিনের কাছেও- আপনাদের রিজার্ভ বাহিনী কই? নাৎসিরা মেউজ নদী আর আমিয়ান্সে কিভাবে নদী পার হলো? কোথায় আপনাদের প্রতিরোধ।চার্চিলের মনে নিজের দেশের ৪ লাখ ব্রীটিস বাহিনীর কথা এসে যায়,যারা ব্রিটিস অভিযাত্রী বাহিনী নামে ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ফ্রান্সে থাকে ।এদের কি হবে? চার্চিল ও ইংল্যান্ড জানে ,১ম বিশ্বযুদ্ধে ৫ লক্ষ ব্রিটিস সন্তান ফ্রান্স আর বেলজিয়ামের মাটিতে ঘুমিয়ে আছে।সেবার শুধু বেলজিয়ামে প্যাসেন্ডেলে ইপ্রে দখলের সেকেন্ড ফেজে আড়াই লক্ষ ব্রিটিস সৈন্য নাই হয়ে যায়।
গ্যামেলিন সেটাই বলে যেটা চার্চিল শুনতে চাচ্ছিলো না।গ্যামেলিন জিজ্ঞেস করে- ব্রিটিস অভিযাত্রী বাহিনী কি এই মুহুর্তে পালটা আক্রমন দিবে,ফরাসীদের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে? চার্চিল জানায় প্রশ্নই উঠে না।ব্রিটিসরা এখন তাদের অভিযাত্রী বাহিনীকে রক্ষা করবে যাতে অন্যকোনদিন অন্যকোন রণক্ষেত্রে এই বীরেরা নামতে পারে।ব্রিটিস অভিযাত্রী বাহিনী ফ্লান্ডার্সের দক্ষিনে ডানকার্কে সমুদ্রের পার টুকুতে আটকে আছে।তাদের বিপরীতে আছে জেনারেল রোমেল।হিটলার কোন এক অজ্ঞাত কারনে এই ব্রিটিস বাহিনীকে আপাতত কিছু করছেন না।আর রোমেল খুবই ক্ষুদ্ধ হয়ে আছে ফুয়েরারের উপর।তার এই সাড়ে তিন লাখ ব্রিটিস অভিযাত্রী বাহিনীকে আটলান্টিকে ঠেলে ফেলে দেয়ার চুড়ান্ত ইচ্ছা।
চার্চিল রাতেই ইংল্যান্ড ফিরে।খবর চারদিক খারাপ।ফরাসী সেনাবাহিনী বিধবংশ হয়ে যাওয়াতে ফরাসী নৌ-বাহিনী সমস্ত সরঞ্জাম নিয়ে আলজিয়ার্সের ওরান বন্দরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।চার্চিলের দৃঢ় বিশ্বাস এরা জার্মান নৌবহরের কাছে ধরা দিবে।উনি একটা মারাত্বক সিদ্ধান্ত রাজকীয় মেরিনকে দিয়ে রেখেছেন।ফরাসী নৌবহর ওরান বন্দরে ব্রিটিস মেরিনকে নেতৃত্ব বুঝিয়ে সরঞ্জামের দায়িত্ব দিয়ে দেবে ।নচেৎ ডেপথ চার্জ করে সমস্ত ফরাসী নৌযান ডুবিয়ে দেবে।তারা তাই করেছিলো।আঘাতের পর আঘাতে ফ্রান্স ম্রিয়মান হয়ে যায়।জেনারেল ডিগল একে পাশবিক আবেগের অভিব্যক্তি বলে অভিহিত করেছেন।
এবার জেনারেল লর্ড গর্ট।তিনি ফরাসী বাহিনীর অবস্থা দেখে রাতেই চার্চিলের সাথে বেতার বার্তায় বসেন।পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় সমগ্র মন্ত্রীসভা গর্টের কাছে জানতে চায়, আপনি কি করবেন?গর্ট একেবারে সংক্ষেপে জানায় ,আমার বাহিনীকে বাচাতে হবে।যদি সাড়ে তিন লাখের এক তৃতিয়াংশ আমি মেইন ল্যান্ডে নিতে পারি সেটাও ভাগ্য।আপনারা জাতিকে ভয়ঙ্কর দূ;সংবাদের জন্য প্রস্তুত রাখুন।আর আমি সৈন্যদের সাথেই থাকছি।তাদের পাশে আমি মৃত্যুবরন করতে চাই।
চার্চিল সমস্ত রাজকীয় বিমান বহরকে ডানকার্কের চারপাশের নাৎসি অবস্থানে অব্যাহত বোমাবর্ষনের নির্দেশ দেন। সমগ্র রাজকীয় মেরিন তাদের রিকুইজিশন করা ভ্যাসেল নিয়ে এসে হাত লাগায়.২৭ মে থেকে ৪জুন পর্যন্ত সময়ে জেনারেল গর্ট ৩লাখ ৩৮হাজার সৈন্য পার করে উদ্বাসনের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলে।সর্বশেষের নৌযানে লর্ড গর্ট ইংল্যান্ডে নামে।এই বেচে ফেরা বীর সৈনিকেরা ঠিক ৪ বছর পর আবার নরমান্ডিতে মানব ইতিহাসের বৃহত্তম ল্যান্ডিং অভিযানে নামে।সেটা ছিলো ৬জুন,১৯৪৪ ডি-ডে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন