শাসনকালের প্রায় ৫০০ বছর পরে ঐতিহাসিক মাউন্ট স্টুয়ার্ট এলফিনস্টোন তার বইয়ে লিখে যান, মুহম্মদ বিন তুঘলক তার যুগের সাথে বেমানান লোক ছিলেন।তিনি বদ্ধ উম্মাদ, সাইকো ,জৌতিবিদ্যা ও গণিতে দক্ষ ছিলেন।তুঘলকের সাথে সময় পার করেছেন ইবনে বতুতা ও ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বরনী।তারা অবশ্য চা ছাকনী দিয়ে ছেকে যতোটুকু লিখলে জান বাচানো যায় ততোটুকু লিখেছেন।জান বাচানো ৩ ফরজ।
ইবনে বতুতা তার রাজত্বে ৮ বছর কাজীর দায়িত্ব পালন করেন।তিনি বলেন ,হেন কোন দিন নাই সুলতানের দরবারের মুখে বস্তাবন্দী লাশের স্তুপ ছিলো না।তিনি অবাধে মৃত্যুদন্ড দিতেন।চোরের হাত কেটে দিতেন, বেত্রেঘাত বা চাবুকের উপযুক্ত অপরাধীকে চাবকাতেন।মোটামুটি একটা রক্তাত অধ্যায়।ইবনে বতুতাকে তিনি ১২ হাজার স্বর্নমুদ্রা বছরে বেতন দিতেন, তাই বতুতা খুব আনন্দে ছিলেন।কিন্তু তিনি শেষের বছরে একটা ভুল করে ফেলেন।তিনি বুজুর্গ দরবেশ শেখ শিহাব উদ্দীনের সাথে সাক্ষাত করেন।পুরো দিল্লীতে শুধুমাত্র এই দরবেশই তুঘলকের কঠোর সমালোচনা করতেন। তাই তুঘলক এই দরবেশকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেন।আর বতুতার সমস্ত দায়িত্ব কেড়ে নেন। ৪জন আজরাইল সদৃশ্য মামলুক দেহরক্ষী তাকে সর্বক্ষন পাহাড়া দেয়া শুরু করে।ডরে বতুতার খানা-দানা বন্ধ হয়ে যায়।তিনি শুকিয়ে যান, তিনিও দরবেশের জীবন-যাপন শুরু করেন।
জিয়াউদ্দীন বরনী বলেন, সুলতান নাগরিকদের উপর অত্যাধিক কর বসান।একিই সাথে নতুন করে তাম্র-মুদ্রা চালু করেন।কিন্তু সেটা সস্তা-গোছের হওয়াতে বাজারে বিপুল জাল মুদ্রার আনাগোনা হয়ে রাজকোষ শুন্য হয়ে পড়ে ।তুঘলক আরো ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে।এমতাবস্থায় তুঘলক দূষ্ট অবাধ্য নাগরিকদের দমনে ব্যাপক গোয়েন্দা নামিয়ে দেন। জনগন সমালোচনা না করতে পেরে যেহেতু তখন ফেসবুক এর ওয়াল ছিলো না,তাই দিল্লীর প্রাচীরের ওয়ালে তুঘলকের বাপ-মা-মাসীর নামে যা তা কহতব্য নয় এমন জিনিস লিখে রাখতো।তুঘলক তার হত্যাযজ্ঞ ব্যাপক আকারে বাড়িয়ে দেন।সাথে করে বালিকা গোয়েন্দাও নিয়োগ দেন ,এরা আমীর ওমরাহের বাড়িতে নিয়োজিত থাকতো।এরা গোপন খবর দিতো মেথরদের,মেথররা দিতো শহরের গোয়েন্দা প্রধানদের।আমাদের শাসকরা এখন বেডরুমের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে কি হবে তুঘলক সফল হয়েছিলো বেডরুমে নিরাপত্তা দিতে।তেমনি এক ঘটনা ইবনে বতুতা বলেন, এক আমীর রাত্রে তার স্ত্রীর সাথে সংগম করতে চাইলে আমীরের স্ত্রী বলেন আজ তার মুড নাই ।কিন্তু আমীর জোর করে করতে চাইলে স্ত্রী তাকে সুলতানের মাথার দিব্যি দিয়ে আজকে করতে মানা করে।আসল পুরুষ আমীর শুনে নাই নিষেধাজ্ঞা। বালিকা গোয়েন্দা মেথর গোয়েন্দা প্রধান হয়ে তুঘলকের কানে এ কথা উঠে।তার নাম শোনার পর মাথার দিব্যি দেওয়ার পরও যার এশ উঠে তার মৃত্যুদন্ড ফরজে আইন।আমীর নিহত হন।
এমন অবাধ্য নগরীকে শাস্তি দেওয়া সুলতান স্থির করেন।তিনি দিল্লী থেকে ২০০০ মাইল দূরে মহারাষ্ট্রের দৌলতাবাদে রাজধানী সরিয়ে ফেলেন ।নগরবাসী মাত্র ৩ দিন সরে যাবার সময় পায়। সরে যাবার দিন দেখা যায়,শুধু এক পঙ্গু আর এক অন্ধ জানায় তারা যাবে না।সুলতান পঙ্গুকে উচু পাহাড়ের উপর থেকে ফেলে হত্যা করে আর অন্ধকে দুই পা ঘোড়ার সাথে বেধে দৌলতাবাদ পর্যন্ত টেনে নেওয়ার হুকুম দেন।দৌলতাবাদ পৌছার পর দেখা যায় অন্ধের শুধু দুই পা আছে।শাহনামা ই হিন্দ এর লেখম ইসামা বলেন।এভাবে তড়িঘড়ি করে দিল্লী ছাড়ার সময় তার ৯০ বছর বয়সী বাবা প্রবল অসুস্থতায় অজ্ঞান ছিলেন।ফলে তাকে সেই অবস্থায়ই গড়ুর গাড়িতে করে নিয়ে সবাই রওয়ানা হন।সপ্তাহ খানেক পর জ্ঞান ফিরে উনি দেখেন এক গরুর গাড়িতে উনি,আর তার চারদিকে দূর্গম বন ,পাহাড় ও জীব জন্তু।তিনি জানতে চান,কোথায় তার দিল্লীর হাভেলি? সবাই বোঝায় পাগলের বাচ্চা পাগল দিল্লীর কি অবস্থা করেছে।উনি সেখানেই স্ট্রোক করে মারা যান।্দিল্লীর চার ভাগের একভাগ মাত্র লোক জীবিত দৌলতাবাদে আসে।
তারপর লম্বা কাহিনী ,দৌলতাবাদ একসময় তুঘলকের কাছে অসহ্য হয়ে যায়।তিনি আবার সবাইকে দিল্লী ফেরার আদেশ দেন।সেই পঙ্গু আর অন্ধ লোকের পরিনতি চিন্তা করে সবাই তার সাথে উদগ্রীব হয়ে রওয়ানা দেন।
তুঘলক এ যাত্রায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন।তার লিভার যকৃত ক্ষতিগ্রস্থ হয়।সেখান থেকেই তিনি এক মরু ডাকাতের পিছে ধাওয়া করেন।ক্লান্ত শ্রান্ত সেনাবাহিনী বলে এর পিছে ছুটবেন না।এ ডাকাত না ,স্বয়ং মৃত্যু।কিন্তু তুঘলক ছুটলো।এবং বৃথায় ঘুরে আরো দূর্বল হয়ে পড়লেন।এসময় সিন্ধু নদের কাছে থাট্টায় নদী পেরোতে গেলে একটা তেলতেলে পাল্লা মাছ বা সিন্ধুর ইলিশ মাছ দেখে তার খুব খেতে ইচ্ছা করলো।হাকিম জানালো,সুলতান এটা খাবেন না।আপনার শরীরের কলকব্জা সব মরুভূমিতে ঘুরে বিকল হয়ে গেছে।এটা আপনার সহ্য হবে না। সত্যিই এ মাছ খাওয়ার পর ফুড পয়জনিং এ মুহম্মদ বিন তুঘলক অবশেষে মৃত্যুর কাছে হার মানে।
ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বরনী ব্যাপারটাকে এভাবে লিখেছেন, এভাবে অত্যাচারী সুলতান তুঘলকের হাত থেকে জনগন, আর জনগনের হাত থেকে অত্যাচারী সুলতান উভয়ে নিস্কৃতি পেয়ে গেলো।
বাংলা ভাষায় পাগলামীর সমার্থক তুঘলকী কান্ড এই সুলতানের কর্ম থেকেই উদ্ভুত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন